বাড়ির মধ্যে বা চেনা পরিসরে সে চনমনে, প্রাণোচ্ছ্বল। অথচ বাইরের লোকজনের সামনে এলেই গুটিয়ে যায়। এমনকি, কোনও অসুবিধা হলেও মুখ থেকে রা সরে না। খেলতে যাওয়া, অন্যদের সঙ্গে গল্প করা সবেতেই কেমন যেন গুটিয়ে থাকে। একমাত্র আপনার সন্তানেরই এমন স্বভাব আছে, তা কিন্তু নয়। বরং এই ধরনের জটিলতা ঘিরে ধরে আজকাল অনেক শিশুকেই।
আজকাল প্রায় সব বাড়িতেই মা-বাবা কর্মরত। সন্তান থাকে হয় দাদু-দিদিমা বা ঠাকুরদা-ঠাকুরমার কাছে, নয়তো তাঁদের দেখভালের জন্য নিযুক্ত মানুষের জিম্মায়। স্কুল, পড়াশোনা, টিউশন, কো কারিকুলামের চাপে খেলা প্রায় বন্ধ।
খেললেও বাড়ির মধ্যে কম্পিউটারে বা মোবাইলে। ছোট থেকেই নিজের জগৎ তৈরি করতে গিয়ে হয়তো কোথাও ঠোক্কর খাচ্ছে আপনার সন্তান। স্কুলজীবন শুরু হলেও সে আর পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে মিশতে পারছে না। ছোট বয়সেই ঘিরে ধরছে একাকিত্ব। ছোট থেকেই এই সমস্যা না সামলালে পরে তা বড় আকার নেবে।
তাই এই সমস্যা থেকে তাকে বার করুন এখনই। তবে তার একার চেষ্টায় নয়, এই জার্নিতে তার পাশে থাকুন আপনিও। নজর দিন এ সবে।
সারা ক্ষণ কুক্ষিগত না রেখে ওকে মিশতে দিন।
সন্তানকে মিশতে দিন: অনেক অভিভাবক তাঁর সন্তানকে কাছছাড়া করেন না। যে কোনও অনুষ্ঠানবাড়ি বা বেড়াতে গিয়েও সব সময় সন্তানকে কিছু না কিছু দিয়ে চোখের সামনে বন্দি করে বসিয়ে রাখেন। কোনও কোনও অভিভাবক আবার সন্তানের সঙ্গে কেউ কথা বলতে এলেও সমানে জরিপ করতে থাকেন।
ওবার পোজেসিভ হয়ে নিজেরাই উত্তর দিতে থাকেন। এতে ওর নিজের সম্পর্কে বলার, মেলামেসার অভ্যাস তো তৈরি হয়ই না, উল্টে ভিতরে ভিতরে ভয়ও দানা বাঁধে। তাই নিজে সব উত্তর না দিয়ে বরং সন্তানকেই সাহায্য করুন গুছিয়ে উত্তর দিতে। চোখের সামনেই রেখেও সকলের সঙ্গে সাবলীল ভাবে মিশতে দিন।
অভিযোগ নয়: সন্তানের সামনে তার নেতিবাচক দিক নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মশকরা একেবারেই নয়। অতিরিক্ত রাগ দেখালেও চলবে না। অন্তর্মুখী শিশু অনেক সময় বাইরে মিশতে পারে না। বন্ধুরা মেলামেশা করতে পারলেও সে হয়তো দলে থেকেও সে ভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে না।
এমন সময় তাঁর সম্পর্কে অন্যের কাছে নেগেটিভ মন্তব্য করবেন না। বরং সে যাতে সকলের সঙ্গে আলাপ করতে চায়, বন্ধুত্ব করতে পারে, সে ক্ষেত্রে নিজেই এগিয়ে আসুন। ওর চারপাশ এবং ওর মধ্যে সেতুর কাজ করে জীবন সহজ করে তুলুন সন্তানের। একটা সময়ের পর দেখবেন ও নিজেই এই কাজে ওস্তাদ হয়ে উঠছে।
উত্তর দিক সন্তান: অচেনা কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে অনেক সময় অনেক শিশুই তার উত্তর দিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে অনেক মা-বাবাই তার জড়তা ঢাকতে বা শিশুকে উত্তর না দিতে দিয়ে নিজেই জবাব দেন।
এমন করলে শিশু কোনও দিনই মেশার পরিবেশ পাবে না। আত্মবিশ্বাসে ঘা লাগে। সে ধরেই নেয় উত্তর সে না দিলেও চলবে। বরং হালকা চালে সন্তানকেই নানা ভাবে উত্তর দিতে প্ররোচিত করুন। ওকে সেখান চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি কথা বলতে। কম কথা বললেও যেটুকু বলে তা যেন চোকের দিকে তাকিয়ে বলে। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
খেলাধুলো করালে সন্তান নিজেই মিশতে শুরু করবে অন্যদের সঙ্গে।
পারফর্ম করার চাপ নয়: সন্তানের কোনও বিশেষ গুণ থাকলে তা বাইরের কারও সামনে প্রকাশ করার অভ্যাস ছোট থেকে তৈরি হওয়া ভাল। এতে মেশার ক্ষমতার সঙ্গে সেই গুণ নিয়ে জড়তোও কাটে, তবে তা যদি নিজে চায়, তবেই। অকারণে চাপ দিয়ে, জোর করে পারফর্ম করাবেন না।
খেলতে দিন: বাড়িবন্দি করে না রেখে প্রতি দিন তাকে বাইরের আরও কয়েক জন শিশুর সঙ্গে মিশতে দিন। কোনও খেলার মাঠ বা পার্ক থাকলে সেখানে তাকে নিয়ে গিয়ে খেলতে দিন। প্রথম দিকে জড়তা থাকলেও এক সময় সে নিজেই মিশতে শুরু করবে অন্যদের সঙ্গে। শুধু নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখে নিজেদের সঙ্গে খেলতে দিলে ওর জড়তা কিন্তু কাটবে না।
বুদ্ধি খরচ: শিশুর মেলামেশার জড়তা আছে বুঝলে টুকটাক দায়িত্বে তাকে এগিয়ে দিন। বাড়িতে অতিথি কেউ এলে তাঁকে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেওয়া বা দোকানে গেলে কোনও কিছুর দাম জানতে চাওয়া, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাকে নিজের সুবিধা-অসুবিধার অন্তত বেসিকটুকু জানিয়ে রাখা, এগুলোয় ওকেই এগিয়ে দিন। নিজে দূর থেকে পাহারা দিন সন্তানকে। ধীরে ধীরে ভয় কাটবে এতে।