জন্মের পর থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই ভাই শাহিন মিয়া (৩০) ও সাজু ইসলাম (২০)। শারীরিক এ প্রতিবন্ধকতায় লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি তাদের। তবে তাদের স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দেশের কয়েকজন মন্ত্রী, স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ গ্রামের প্রায় ১ হাজার ২০০ জনের মোবাইল নম্বর মুখস্থ বলতে পারেন তারা। গ্রামের কারও নাম বললেই বলে দেন তাদের মোবাইল নম্বর।দুই ভাই একবার কোনো ব্যক্তির মোবাইল নম্বর শুনলেই তা মুখস্থ করে ফেলেন।
স্বাভাবিকভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর পক্ষে যা একেবারে অসাধ্য, তাই সাধন করে দেখিয়েছেন হার না মানা শাহিন মিয়া ও সাজু ইসলাম। অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান এই দুই যুবক লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা তীরের উত্তর সির্ন্দুনা গ্রামের দিনমজুর নুর ইসলামের সন্তান। বড় ছেলের নাম শাহিন মিয়া ও ছোট ছেলে সাজু ইসলাম। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী হয়েও ঘরে বসে নেই শাহিন মিয়া।
বাড়িতে বসে ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা পরিচালনা করেন। দুই ভাইয়ের অন্তত ১ হাজার ২০০ মানুষের মোবাইল নম্বর মুখস্থ রয়েছে। নাম বললেই নির্দিষ্ট ব্যক্তির মোবাইল নম্বরে পাঠিয়ে দেন ফ্লেক্সিলোডের টাকা। আবার কারও কণ্ঠ শুনে, আবার কারও মোবাইল নম্বর বললেই ওই ব্যক্তির মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন জন্মান্ধ শাহিন (৩০)। অন্য ভাই সাজু ইসলাম প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের সবার নম্বর তার মুখস্থ। তিনিও নাম বলা মাত্রই বলে দেন মোবাইল নম্বর।
তাদের বাবা নুর ইসলাম পেশায় একজন দিনমজুর। নদীতে সব জমি বিলীন হয়ে মাত্র ১৫ শতক জমির ওপর তাদের বসতবাড়ি। দিনমজুরি ও অন্যের জমি চাষ করে কোনোমতে অতিকষ্টে ছয়জন সদস্যের সংসার চলে। মা ছালেমা বেগম গৃহিণী। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাজু ইসলাম ও শাহিন মিয়া প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী। তারপরও অনেক কষ্টে চলছে তাদের সংসার। টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে শাহিনের ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাহিন মিয়া বলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা করে সবার মোবাইল নম্বর মুখস্থ হয়েছে। আগে এই ব্যবসা করতে কষ্ট হলেও এখন আর হয় না। বর্তমানে টাকার অভাবে ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।
কেউ যদি এ ব্যবসা করতে সহযোগিতা করতেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকতাম। ছোট ভাই সাজু ইসলাম বলেন, সরকারি ৩৩৩ নম্বরে কল করে প্রধানমন্ত্রীসহ সবার নম্বর সংগ্রহ করে তাদের নম্বর মুখস্থ করেছি। আমার প্রতিবন্ধী ভাতা ও সরকারি পাকাঘর পাওয়ার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক ও সরকারি বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের কথামতো প্রতিবন্ধীর ভাতা ও ঘর পাওয়ার আবেদন করি। আবেদনের পর পাকাঘর ও ভাতা পেয়েছি।
প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষক ও গবেষক রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা জানান, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দুই ভাইয়ের অনেক প্রতিভা রয়েছে। তারা একবার কারও মোবাইল নম্বর শোনামাত্রই তা মুখস্থ করে ফেলে। তিনি আরও জানান, শাহিন ও সাজুকে মুদির দোকান ও গাভি পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন সহযোগিতা করলে তাদের পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে।উত্তর সির্ন্দুনা গ্রামের সাগর ইসলাম বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই ভাই অনেক ব্যক্তির নম্বর মুখস্থ করেছেন। নাম বললেই তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোবাইল নম্বর বলে দিতে পারেন। আমরা বিপদের সময় তাদের কাছ থেকে অন্যের নম্বর সংগ্রহ করি।
এ বিষয়ে হাতীবান্ধা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহাবুর আলম জানান, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই ভাইয়ের ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। তারা প্রতিমাসে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন।হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামিউল আমিন বলেন, তাদের সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে। তাদের ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পের আওতায় পাকাঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে। তারা দুই ভাই-ই প্রতিভাবান।